সুভা গল্পের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
১. সুভাষিণী নামটি সার্থক হয়নি কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: সুভা জন্ম থেকেই বাক্প্রতিবন্ধী ছিল বলে সুভাষিণী নামটি সার্থক হয়নি। সুভার বাবা-মা তার বড়ো দুই বোনের নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখেন ‘সুভাষিণী’, যার অর্থ সুন্দরভাবে কথা বলা। কিন্তু সুভা জন্ম থেকেই কথা বলতে পারত না। তার মা তাকে নিজের গর্ভের কলঙ্ক মনে করতেন। মূলত বাক্প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণেই ‘সুভাষিণী’ নামটির অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যর্থ হয়ে যায় এবং নামটি সার্থকতা পায় না।
২. ‘পিতামাতার নীরব হৃদয়ভার’- কথাটি দ্বারা, লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর: সুভা কথা বলতে না পারায় তার বিয়ে হচ্ছিল না বলে সে তার পিতামাতার মনে নীরব হৃদয়ভার, অর্থাৎ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গল্পের সুভা একজন বাক্প্রতিবন্ধী কন্যা। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হলেও সুভার বিয়ে হচ্ছিল না। প্রতিবন্ধী মেয়েকে কীভাবে বিয়ে দেবেন, এই দুশ্চিন্তা সুভার বাবা-মায়ের মনে পাথরের মতো চেপে বসে। ‘নীরব হৃদয়ভার’ কথাটি দিয়ে লেখক তাদের এই অব্যক্ত কষ্টকেই প্রকাশ করেছেন।
৩. সুভার অনুভূতি কেমন ছিল তা ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: সুভা বাক্প্রতিবন্ধী হলেও সে অনুভবশক্তিতে সমৃদ্ধ ছিল। সে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে মনের ভাব বিনিময় করতে পারত। পরিবারের সদস্যরা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করত, যা সে অনুভব করত এবং নিজেকে সকলের আড়াল করে রাখত। তবে সে প্রকৃতি ও প্রাণীর সাথে সখ্য গড়ে তোলে এবং অনুভব করত তাদের ভাষাও। সুভার মাধ্যমে বোঝা যায়, কথা বলতে না পারলেও মানুষের অনুভূতি থাকতে পারে।
৪. সুভা নিজেকে সর্বদা গোপন রাখার চেষ্টা করত কেন?
উত্তর: বাক্প্রতিবন্ধী সুভাকে সবাই সংসারের বোঝা বলে মনে করত এবং এই বাস্তবতা সে বুঝতে পারত বলেই নিজেকে সর্বদা গোপন রাখার চেষ্টা করত। শিশুকাল থেকেই সুভা উপলব্ধি করেছিল, সংসারে সে অবাঞ্ছিত। কেউ তার অনুভূতি বোঝে না, বরং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। এতে করে তার মধ্যে হীনম্মন্যতা জন্ম নেয় এবং সে নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করতে শুরু করে।
৫. ‘আমাকে সবাই ভুলিলে বাঁচি’- সুভার এমন মনোভাবের কারণ কী?
উত্তর: বাক্প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে সুভা ‘আমাকে সবাই ভুলিলে বাঁচি’ মনোভাব পোষণ করত। সে নিজেকে অসহায় এবং সমাজে অবহেলিত মনে করত। কেউ তার অনুভবশক্তিকে গুরুত্ব দিত না। নিজের দুর্বলতা নিয়ে সে লজ্জিত ছিল এবং বিশ্বাস করত, যদি কেউ তাকে না দেখে বা মনে না রাখে, তবে তার কষ্ট কিছুটা লাঘব পাবে। এই আত্মপ্রত্যাখ্যান থেকেই এমন ভাবনার সৃষ্টি হয়।
৬. সুভা পিতামাতার মনে সর্বদাই জাগরুক ছিল কেন? বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: সুভা বাক্প্রতিবন্ধী হওয়ায় তার ভবিষ্যৎ নিয়ে পিতামাতার মনে সবসময় এক অস্থিরতা কাজ করত, এজন্য সে সর্বদাই তাদের মনে জাগরুক ছিল। তার মা তাকে গর্ভের কলঙ্ক মনে করতেন। বাক্প্রতিবন্ধকতার কারণে সুভার বিয়ে বা ভবিষ্যতের চিন্তায় বাবা-মা সবসময় উদ্বিগ্ন থাকতেন। এই অজানা আশঙ্কা ও দায়বোধ তাদের মনে সুভাকে একটি স্থায়ী ভার হিসেবে রেখে দেয়।
৭: মা সুভাষিণীকে নিজের ত্রুটিঘরূপ দেখতেন কেন?
উত্তর: সুভা বাক্প্রতিবন্ধী হওয়ায় তার মা তাকে নিজের ত্রুটিস্বরূপ ভাবতেন। সাধারণত মায়েরা পুত্রের চাইতে কন্যাকে নিজের একটি অংশ হিসেবে মনে করেন। তাই কন্যার কোনো অপূর্ণতা বা প্রতিবন্ধকতা তাদের কাছে নিজের কলঙ্ক মনে হয়। ‘সুভা’ গল্পের সুভার মা তার প্রতিবন্ধী কন্যাকে নিজের গর্ভের কলঙ্ক মনে করতেন। ফলে সুভাকে তিনি যেন নিজের জীবনের একটি ত্রুটির প্রতীক ভাবতেন।
৮: ‘কালো চোখকে কিছু তর্জমা করিতে হয় না।’ — কেন বলা হয়েছে?
উত্তর: মানুষের মনের ভাব চোখের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ পায়, এজন্য এই কথাটি বলা হয়েছে। কথা বলতে গেলে অনেক সময় ভাবকে শব্দে অনুবাদ বা তর্জমা করতে হয়। কিন্তু চোখের মাধ্যমে প্রকাশিত ভাব সরাসরি অনুভূত হয় এবং তা আর কোনো শব্দের ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয় না। চোখ হলো অনুভূতির একটি প্রাকৃতিক ভাষা, যেখানে শব্দের সীমাবদ্ধতা থাকে না। তাই ‘কালো চোখকে’ অর্থাৎ চোখের ভাষাকে আলাদা করে অনুবাদ বা ব্যাখ্যা করতে হয় না।
৯: ‘বাক্যহীন মনুষ্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ত্ব আছে।’ — ‘সুভা’ গল্পের লেখকের এই উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: এই উক্তিতে লেখক বাক্প্রতিবন্ধী মানুষের গভীর মনোজগতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যেভাবে নির্জন প্রকৃতির মধ্যেও নানা ভাষা এবং জীবন রয়েছে, তেমনি ভাষা বলতে না পারলেও বাষ্প্রতিবন্ধীরা আকারে-ইঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম। বাইরের সমাজের সঙ্গে তারা ততটা মিশতে না পারলেও, নিজের মনেই একটি ভিন্ন চিন্তার জগত তৈরি করে, যেখানে তাদের নিজস্ব ভাবনা ও অনুভূতি নিহিত। এই ‘বিজন মহত্ত্ব’ বা বিশালতা-ই লেখকের মূল বক্তব্য।
১০. ‘সুভা’ গল্পে উল্লিখিত নদীটিকে ‘গৃহস্থঘরের মেয়েটির মতো’ বলা হয়েছে কেন?
উত্তর: অপ্রসারমানতা ও দুই তীরের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য ‘সুভা’ গল্পে উল্লিখিত নদীটিকে ‘গৃহস্থঘরের মেয়েটির মতো’ বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘সুভা’ গল্পে সুভাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটির কথা বর্ণিত হয়েছে। নদীটি খুব বেশিদূর পর্যন্ত বিস্তৃত নয়। তবে নদীর দুই তীরের মানুষ ও প্রকৃতির সাথে এর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। নদীটি এ সম্পর্ক রক্ষা করেই প্রতিনিয়ত বয়ে চলছে। এ কারণেই লেখক নদীটিকে গৃহস্থঘরের মেয়ের সাথে তুলনা করেছেন। কেননা, গৃহস্থঘরের মেয়েদের গণ্ডিবদ্ধ জীবন ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের সাথে থাকা আত্মিক সম্পর্কের সাথে নদীটির অবস্থা তুলনীয়।
১১. ‘সুভা’ গল্পে ‘গ্রামলক্ষ্মী স্রোতম্বিনী’ কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘সুভা’ গল্পে ‘গ্রামলক্ষ্মী স্রোতম্বিনী’ বলতে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটির মাহাত্ম্য বোঝানো হয়েছে। আলোচ্য গল্পে বর্ণিত গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোটো একটি নদী। আপন খেয়ালে অবিরলভাবে বয়ে চলেছে সে। চলার পথে দুধারে সৃষ্টি করেছে শ্যামলিমা ও সমৃদ্ধি। গ্রামটি যেন এ নদীর আশীর্বাদপুষ্ট। নদীটিকে তাই সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মীর সাথে তুলনা করেছে।
১২. ‘প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভার পূরণ করিয়া দেয়।’- ব্যাখ্যা
উত্তর: প্রশ্নোন্ত উক্তিটিতে প্রকৃতির সঙ্গে সুভার গভীর সম্পর্কের বিষয়টিই উন্মোচিত হয়েছে। নদীর তীরে বসলে সুভা নদীর কলধ্বনি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর সমস্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। এগুলো যেন তার হয়ে কথা বলত। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতিও সুভার ভাষার মতো নীরব অথচ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। আর তাই লেখক বলেছেন, ‘প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়।’
১৩. ‘সুভা’ গল্পে ‘চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূল’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘সুভা’ গল্পে ‘চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূল’ বলতে বোঝানো হয়েছে সুভার বাশূন্য জীবন বাস্তবতা। সুভা কথা বলতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতির বিভিন্ন শব্দ এবং নানা ধরনের চলাফেরাই তার ভাষার অভাব পূরণ করে দেয়। নদীর কলকল শব্দ, মানুষের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, পাতার মর্মর এসব মিশে চারপাশের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে সুভার শান্ত জীবনে শব্দের স্পন্দন সৃষ্টি করে। এখানে ‘চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূল’ বলতে সুভার নির্জন, শান্ত দ্বীপের মতো শব্দহীন জীবন বোঝানো হয়েছে।
১৪. ‘তাহার মর্ম তাহারা ভাষার অপেক্ষা সহজে বুঝিত’- ব্যাখ্যা
উত্তর: প্রশ্নোত্ত উক্তিটি দ্বারা গোয়ালের দুইটি গাভির সঙ্গে সুভার ভাষাহীন যোগাযোগের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। সুভার খুব কাছের দুইটি গাভি ছিল। সেগুলোর নাম ছিল সর্বশী আর পাঙ্গুলি। গাভি দুটো সুভার পদচারণা শুনলেই তার উপস্থিতি বুঝত এবং কথা না বললেও তার মনোভাব সহজেই ধরত। সুভার নীরব সুর যেন বোবা প্রাণী দুইটিকে নিজেদের মধ্যে এক বিশেষ অনুভূতি দিয়ে যুক্ত করত, যা সাধারণ ভাষা বোঝার প্রাণীদের জন্যও সম্ভব ছিল না।
১৫. ঘরে কঠিন কথা শুনে সুভা গোয়ালঘরে যেত কেন?
উত্তর: বন্ধুস্বরূপ গাভি দুইটির কাছ থেকে সান্ত্বনা লাভের জন্য ঘরে কঠিন কথা শুনলে সুভা গোয়ালঘরে যেত। কোনো ভর্ৎসনা বা কঠিন কথা শোনার পর সুভা গোয়ালঘরে গিয়ে তার মূক বন্ধু দুইটির কাছে আসত। সুভার শান্ত ও বিষণ্ণ চোখের দিকে দেখে ওই দুই গাভি যেন কোনো অদৃষ্টময় শক্তি দিয়ে সুভার মনের যন্ত্রণাকে বুঝত। তারা সুভার গায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে তার বাহুতে একটু শিং দিয়ে তাকে নির্বাকভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করত। এতে সুভার মন একটু শান্ত হতো।
১৬. ‘সে ভাষাবিশিষ্ট জীব’-কার সম্পর্কে, কোন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে?
উত্তর: প্রশ্নোক্ত কথাটি প্রতাপ সম্পর্কে, যা তার কথা বলার যোগ্যতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। ‘সুভা’ গল্পে বাক্প্রতিবন্ধী সুভা কথা বলতে না পারায় মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে না। তাই সে কল্পনায় পশুপাখিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে কারণ তারা অবলা আর কথা বলে না। তবে প্রতাপের সঙ্গে তার আলাদা ভালো লাগা, কারণ প্রতাপ কথা বলতে পারে, মানুষের মতো ভাব প্রকাশ করতে পারে। প্রশ্নোক্ত উক্তিটি মূলত এই বিশেষ পার্থক্যটিকেই বোঝাতে চেয়েছে। আর এর মাধ্যমে সুভার ভেতরের একাকিত্ব ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ পায়।
১৭. প্রতাপের প্রতি তার মা-বাবার নিরাশ হওয়ার কারণ বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: প্রতাপ নিতান্ত অকর্মণ্য বলে তাকে নিয়ে তার মা-বাবা নিরাশ ছিল। প্রতাপ ছিল মা-বাবার অকর্মণ্য ছেলে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে দিয়ে সংসারের উন্নতি হয় এমন কোনো কাজ করানো সম্ভব হয়নি। সে ছিল নিতান্ত অলস। কেবল সময় কাটানোর জন্য সে অপরায়ে নদীতীরে ছিপ ফেলে মাছ ধরত। এসব কারণে তার মা-বাবা তার প্রতি নিরাশ ছিল।
১৮. প্রতাপকে নিতান্ত অকর্মণ্য লোক কেন বলা হয়েছে?
উত্তর: প্রতাপ কাজকর্ম করে সংসারের উন্নতির কোনো চেষ্টা করছে না বলে তাকে নিতান্ত অকর্মণ্য লোক বলা হয়েছে। ‘সুভা’ গল্পে গোঁসাইদের ছোটো ছেলে প্রতাপ। সংসারের জন্য কাজে তার মন নেই। অকর্মণ্য লোক বলে অনাত্মীয়রা তাকে নিয়ে নানা ধরনের কাজ করিয়ে নেয়। অলস সময়ে সে ছিপ ফেলে মাছ ধরে। কাজকর্ম করে সংসারের উন্নতির চেষ্টা করে না বলে প্রতাপকে নিতান্ত অকর্মণ্য লোক বলা হয়েছে।
১৯. অকর্মণ্য লোকেরা কীভাবে নিঃসম্পর্ক মানুষের প্রিয়পাত্র হয়? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: অকর্মণ্য লোকেরা নিঃস্বার্থভাবে নিঃসম্পর্ক মানুষদের নানা উপকারে আসে বলে তারা প্রায়ই মানুষের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। অকর্মণ্য লোকেরা কোনো কাজে আসে না বলে আত্মীয়রা তাদের উপর বিরক্ত থাকে। কিন্তু অনেক সময় নিঃসম্পর্ক মানুষের কাছে এই অকর্মণ্য লোকেরা প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। কারণ, তারা কোনো কাজ না করায় সবসময় তাদের হাতে অনেক সময় থাকে। ফলে কাজকর্মে, আমোদে-অবসরে যেখানে একটা লোক কম পড়ে সেখানেই তাদের হাতের কাছে পাওয়া যায়।
২০. ‘মাছ ধরার সময় বাক্যহীন সৃঙ্গীই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’- বাক্যটির মানে কী?
উত্তর: ‘মাছ ধরার সময় বাক্যহীন সঙ্গীই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’ বাক্যটির মাধ্যমে প্রাবন্ধিক মাছ ধরার সময় নীরব সঙ্গীর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। গোঁসাইদের ছোট ছেলে প্রতাপ বেশি কাজ করত না, শখ করে ছিপ দিয়ে মাছ ধরত। এই সময়ে সুভার সঙ্গে তার দেখা হতো নদীর তীরে। সুভা নির্বাক হওয়ায় মাছ ধরার সময় তার কোনো বিঘ্ন ঘটত না, আর তাদের সময়ও আনন্দদায়ক কাটত। প্রশ্নোক্ত কথাটির মাধ্যমে এই কারণটাই বোঝানো হয়েছে যে, সুভার নির্বাক ও শান্ত স্বভাব প্রতাপের জন্য মাছ ধরার কাজে উপযুক্ত সঙ্গী হয়ে উঠেছিল।
২১. প্রতাপ সুভার মর্যাদা বুঝত কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মাছ ধরার সময় বাক্যহীন সঙ্গীই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে প্রতাপ সুভার মর্যাদা বুঝত। প্রতাপের প্রধান শখ ছিল ছিপ ফেলে মাছ ধরা। অপরাহ্ণে প্রায়ই সে এই কাজে নিযুক্ত হতো এবং এই উপলক্ষ্যে সুভার সাথে তার প্রায়ই দেখা হতো। প্রতাপ কোনো কাজ করার সময় একজন সঙ্গী পেলে খুব খুশি হতো। সুভা যেহেতু বাক্প্রতিবন্ধী তাই মাছ ধরার সময় সে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে না। এ কারণে প্রতাপ সুভার মর্যাদা বুঝত।
২২. সুভা মনে মনে বিধাতার কাছে অলৌকিক ক্ষমতা প্রার্থনা করত কেন? ব্যাখ্যা করো?
উত্তর: প্রতাপকে অভিভূত করার জন্য সুভা মনে মনে বিধাতার কাছে অলৌকিক ক্ষমতা প্রার্থনা করত। সুভা মনে মনে প্রতাপকে ভালোবাসত। যখন প্রতাপ নদীর ধারে মাছ ধরত, তখন সুভা তার পাশে বসে ভাবত, যদি সে প্রতাপের কোনো কাজে সাহায্য করতে পারত। কিন্তু সে কিছু করতে পারত না। তাই সে ঈশ্বরের কাছে চাইত, যেন কোনো মন্ত্র দিয়ে এমন কিছু করতে পারে যা দেখে প্রতাপ খুব খুশি হয়। আসলে প্রতাপের ভালোবাসা পেতেই সুভা এমন অলৌকিক ক্ষমতা চেয়েছিল।
২৩. পূর্ণিমা রাতে সুভা প্রকৃতির সাথে নিজের সাদৃশ্য অনুধাবন করেছিল কীভাবে?
উত্তর: পূর্ণিমা রাতে সুভা তার শোবার ঘরের দরজা খুলে মধ্যরাতের প্রকৃতির সাথে নিজের ভিতরের সতের সাদৃশ্য অনুধাবন করেছিল। সুভা কথা বলতে পারে না। এই কারণে সে নিজেকে সবাই থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইত। একদিন পূর্ণিমার রাতে সে প্রকৃতিকে নিজের মতো করে দেখছিল। মাঝরাতে প্রকৃতিও যেন খুব একা হয়ে যায়। নিশ্চুপ ও শান্ত প্রকৃতি সুভার মতোই যুবাবস্থার রহস্য আর দুঃখ মিশিয়ে ছিল। সুভা সেই রাতে নিস্তব্ধ ও ব্যাকুল প্রকৃতির মতো নিজের মনের ভিতরের পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারছিল।
২৪. পূর্ণিমা প্রকৃতি কেন সুভার মতো একাকিনী?
উত্তর: পূর্ণিমা প্রকৃতিও সুভার মতোই শব্দহীন হওয়ায় তা সুভার মতো একাকিনী। পূর্ণিমা সৌন্দর্যময়ী কিন্তু শব্দময়ী নয়। তাই এক গভীর পূর্ণিমার রাতে যখন সুভা শয্যাগৃহের বাইরে দাঁড়ায়, তখন সে পূর্ণিমার প্রকৃতিকেও নিজের মতো একাকী মনে করে। যেন ঘুমন্ত জগতের ওপর জেগে বসে, যৌবনের রহস্যে উত্তেজিত আর বিষাদের মধ্যে ডুবে থাকা অসীম নির্জনতার শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু এক কথাও বলছে না। প্রকৃতির এই নিস্তব্ধ ব্যাকুলতা সুভার মতোই একাকী।
২৫. সুভার পিতামাতা চিন্তিত হয়ে পড়লেন কেন?
উত্তর: বাক্প্রতিবন্ধী সুভা বিবাহযোগ্য হয়ে ওঠায় তার বিয়ে নিয়ে পিতামাতা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ‘সুভা’ গল্পে সুভা কথা বলতে পারে না। এই কারণে সবাই খুব চিন্তিত ছিল। তার বয়সও বেড়ে চলেছে, তাই বাক্প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে কোথায় বিয়ে দেবেন তা নিয়ে তার পিতামাতা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাছাড়া, বিয়ের বয়স হলেও তাকে বিয়ে না দেওয়ার কারণে গ্রামের লোকেরা কটাক্ষ করতে শুরু করেছে। এমনকি সুভার পরিবারকেও একঘরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এই সব কারণে সুভার পিতামাতা তার বিয়ের পাত্র খুঁজে পেতে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
২৬. সুভা কলকাতায় যেতে চায় না কেন?
উত্তর: পরিচিত পরিবেশের মায়া ছেড়ে সুভা কলকাতায় যেতে চায় না। বাক্প্রতিবন্ধী সুভা তার চারপাশের পরিবেশকে খুব ভালোবেসে নিয়েছে। কথা বলতে না পারায় তার বেশি বন্ধু নেই, কিন্তু তার কিছু অবলা প্রাণী এবং গোঁসাইদের অলস ছেলে প্রতাপই তার সঙ্গী। এই পরিচিত পরিবেশ আর প্রকৃতিই তার সবচেয়ে বড় আশ্রয়। সে তাই কলকাতার অনিশ্চিত জীবনে যেতে চায় না।
২৭. সুভার সমস্ত হৃদয় অশ্রুবাষ্পে ভরে গেল কেন? বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: বিদেশযাত্রার উদ্যোগ শুরু হলে সুভার সমস্ত হৃদয় অশ্রুবাষ্পে ভরে গেল। সুভা কথা বলতে পারে না। শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক দুশ্চিন্তা থাকে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে বাবা বিশেষভাবে চিন্তিত। একদিন তারা সবাই মিলে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এই বিদেশ যাত্রার কথা শুনে সুভার মনে অজানা ভয় আর উদ্বেগ দেখা দেয়। তার হৃদয় তখন অশ্রুতে ভরে ওঠে।
২৮. ‘দেখিস আমাদের ভুলিস নে।’- প্রতাপ কেন বলেছিল?
উত্তর: বিয়ে হয়ে গেলে সুভা যেন তাকে না ভুলে যায়- প্রতাপ ঠাট্টাচ্ছলে সে কথাটিই বলেছিল। একদিন বিকেলে নদীর ধারে মাছ ধরার সময় প্রতাপ সুভাকে বলেছিল, বিয়ের পর যেন সুভা সবাইকে ভুলে না যায়। এই কথায় প্রতাপ আসলে সুভার জন্য ভালোবাসা এবং শুভকামনা প্রকাশ করছিল। সে চেয়েছিল সুভা যেন বিয়ের পরও সবাইকে ভালো স্মরণ রাখে।
২৯. সুভা মর্মবিদ্ধ হরিণীর মতো তাকিয়েছিল কেন? বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: বিয়ের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করলে সুভা প্রতাপের দিকে মর্মবিদ্ধ হরিণীর মতো তাকিয়েছিল। সুভার বিয়ের প্রস্তুতি চলছে—এই খবর শুনে তার মনে দুঃখ জমে উঠেছিল। তাই অজানা জীবনের পথে যাওয়ার আগে তার মনে যে ভয় ছিল, তা প্রতাপের বিয়ের কথা শুনে আরও বেড়ে গেল। যখন প্রতাপ সুভার বিয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইল, তখন সুভা মর্মবিভৎস হরিণীর মতো তার দিকে তাকিয়ে রইল। এভাবেই সুভার মধ্যে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার বেদনা প্রকাশ পায়।
৩০. ‘আমি তোমার কাছে কী দোষ করিয়াছিলাম’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রিয় মানুষের কাছ থেকে বিদায়ের বেদনা বোঝাতে সুভার অব্যস্ত চাহনিতে উক্তিটি প্রকাশ পায়। বাক্প্রতিবন্ধী সুভা নিজের মতো করে দুঃখ-বেদনা বুঝতে পারে। একদিন সে নিজের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তখন প্রতাপ যখন তাকে বিদায় জানাতে আসে, সুভার চোখে যেন তীব্র অভিমান ঝলমল করে। সুভার ওই অভিমানই আলোচ্য উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
৩১. মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বাণীকণ্ঠের কপোলে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কেন?
উত্তর: মেয়ের প্রতি অসীম ভালোবাসার জন্য তাকে সান্ত্বনা দিতে বাণীকন্ঠের কপোলে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বাক্প্রতিবন্ধী সুভাকে সমাজের কেউ ভালোবাসে না। এমনকি মা-ও তাকে খুব বিরক্ত মনে করেন এবং নিজের গর্ভের কলঙ্ক বলে ভাবেন। কিন্তু সুভার বাবা বাণীকণ্ঠ তাকে অন্য মেয়েদের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তিনি জানেন, সুভার জন্য বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় যাওয়া কত কঠিন হবে। মেয়ের দুঃখ দেখে নিজেও কষ্ট পেয়ে বাণীকণ্ঠ সান্ত্বনা দিতে গিয়ে অশ্রু ফেলেন।
৩২. শম্পশয্যায় লুটিয়ে পড়ল কেন?
উত্তর: চিরচেনা প্রকৃতি ছেড়ে কলকাতায়- চলে যাওয়ার বেদনায় সুভা শষ্পশয্যায় লুটিয়ে পড়ল। কথা বলতে না পারায় কেউ সুভার মনোযাতনাকে ঠিকমতো বুঝতে পারে না। তাই সুভার ভাষাহীন জীবনে নীরব ও অবারিত প্রকৃতিই তার সবচেয়ে বিশ্বাসী সঙ্গী। প্রকৃতিই সুভার মা, পরিবার। কিন্তু সুভার বাবা-মা কলকাতায় তার বিয়ে ঠিক করে দেন। তাই সুভাকে তার পরিচিত প্রকৃতি আর পরিবেশ ছেড়ে শহরে যেতে হবে। এই ভাবনায় সুভার হৃদয় অশ্রুতে ভরে ওঠে। অনেক মনোবেদনা নিয়ে সুভা প্রকৃতির কোলে শুয়ে পড়ে।
৩৩. তুমি আমাকে যাইতে দিও না, মা’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত উক্তিটি দ্বারা লেখক নির্বাক সুভার অসহায়ত্ব এবং প্রকৃতির কাছে তার নির্ভরতা ও আশ্রয় লাভের বাসনার স্বরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। বাক্প্রতিবন্ধী সুভার এক আশ্রয় হলো প্রকৃতি। নিস্তব্ধ প্রকৃতির কাছে সে মুক্তির আনন্দ খুঁজে পায়। তাই যখন কলকাতায় যাওয়ার দিন ঠিক হয়, তখন অজানা ভয়ে ভীত সুভা পরিচিত নদীর তীরে লুটিয়ে পড়ে এবং প্রকৃতি মাকে আশ্রয় চাইতে থাকে। যেমন সুভা প্রকৃতিকে ভালোবাসে, তেমনি সেই ভালোবাসার কারণে সে প্রকৃতির কাছেই নিরাপত্তা খুঁজে নিতে চায়—এটাই প্রশ্নোক্ত উক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে।