বোশেখ কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন
১. ‘জেটের পাখা দুমড়ে শেষে আছাড় মারে’- কোন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে?
উত্তর: কালবৈশাখি ঝড়ের সময় বাতাসের ভয়াবহ রূপ প্রকাশ করতে উক্ত চরণটি ব্যবহার করা হয়েছে।
‘বোশেখ’ কবিতায় কবি বৈশাখ মাসের কালবৈশাখি ঝড়ের শক্তি ও ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। এই ঝড় এতটাই প্রচণ্ড ও দুর্দান্ত যে তার সামনে কোনো কিছুরই টিকে থাকা সম্ভব নয়। কবি বলেছেন, এমন ঝড়ো বাতাসের আঘাতে দ্রুতগতির জেট বিমানও রক্ষা পায় না। শক্তিশালী বাতাসের ধাক্কায় বিমানের পাখা ভেঙে যায় এবং তা মাটিতে পড়ে যায়। এর মাধ্যমে কবি বোঝাতে চেয়েছেন, প্রকৃতির এই বাতাস কতটা শক্তিশালী ও বিধ্বংসী হতে পারে।
২. পবনের কাছে কবি মিনতি করেছেন কেন?
উত্তর: অত্যাচারীর অবসান করার জন্য কবি পবনের কাছে মিনতি করেছেন।
বাংলাদেশে বৈশাখ মাসকে অনেক শক্তিশালী মাস হিসেবে ধরা হয়। এই মাসে প্রায়ই ভয়ংকর কালবৈশাখি ঝড় হয়, যা গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দেয়। এই ঝড়ে অনেক সময় গরিব ও অসহায় মানুষ বেশি কষ্ট পায়, কারণ তাদের ঘরবাড়ি সহজেই উড়ে যায় বা ভেঙে পড়ে। অথচ যারা ধনী, যারা গরিব মানুষকে শোষণ করে বড় বড় অট্টালিকা বানিয়েছে, তারা অনেক সময় নিরাপদে থাকে। তাই কবি চেয়েছেন, যদি প্রকৃতি ধ্বংস করতেই চায়, তাহলে যেন সে এই অত্যাচারী ও শোষকদের ধ্বংস করে, যারা গরিব মানুষের শ্রমে নিজের বিলাসিতা গড়ে তোলে।
৩. কবি বাতাসকে তিষ্ঠ হতে বলেছেন কেন?
উত্তর: কবি গরিব মানুষদের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচাতে বাতাসকে তিষ্ঠ হতে বলেছেন।
বৈশাখ মাসে যে ঝড়বাতাস আসে, তা অনেক সময় গরিব মানুষদের জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। এই ঝড়ো বাতাসে গরিব মাঝির নৌকার পাল ছিঁড়ে যায়, দরিদ্র চাষির কাঁচা ঘর উড়ে যায়, এমনকি আধা-পাকা ঘরও ভেঙে পড়ে। গরিব মানুষের সামান্য যা কিছু থাকে, এই ভয়ংকর বাতাসে সব নষ্ট হয়ে যায়। তাদের জীবন হয়ে পড়ে দুঃখে ভরা ও বিপর্যস্ত। তাই কবি এই বাতাসের কাছে অনুরোধ, যেন সে গরিব ও অসহায় মানুষের ক্ষতি না করে, আর একটু তিষ্ঠ বা ধীর হয়ে চলে।
৪. ‘দয়ালু মেঘের সাথী’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর: সংস্কৃত ভাষার বিখ্যাত কবি কালিদাস ‘মেঘদূতম্’ নামে কাব্য লিখেছেন, যেটিকে বাংলায় বলা হয় ‘মেঘদূত’। এই কাব্যে মেঘকে দয়ালু হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার সঙ্গে বাতাসও ছিল। মেঘ ছিল নরম মনের, কিন্তু তার সঙ্গী বাতাসের মধ্যে কোনো দয়া ছিল না। বাস্তব জীবনেও দেখা যায়, ঝড়ো বাতাস গরিব, অসহায় মানুষ আর প্রাণীদের অনেক ক্ষতি করে। তাই কবি মনে করেছেন, যখন দয়ালু মেঘের সঙ্গে থেকেও বাতাস এমন নির্মম হয়, তখন তারও উচিত মেঘের মতো দয়া শেখা। এইভাবে কবি বাতাসের কাছে করুণার আবেদন জানিয়েছেন।
৫. ‘তবে এমন নিঠুর কেন হলে বাতাস’- কবি কোন প্রসঙ্গে বলেছেন?
উত্তর: ‘তবে এমন নিঠুর হলে কেন বাতাস’- উক্তিটি কবি বৈশাখের আগ্রাসি মনোভাবে আশ্চর্য হয়ে বলেছেন। কবি বৈশাখী বাতাসের অনেক গুণকীর্তন করেছেন। বাতাস ছিল মহাবীর হনুমানের পিতা। কালিদাসের দয়ালু মেঘের সাথি। এমনকি বাতাস ছিল রাজা সোলেমানের বাহন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বৈশাখ মাঝে মাঝে অনেক আগ্রাসি রূপে ধরা দেয়। জনজীবন লন্ডভন্ড করে, দিয়ে যায়। বোশেখের এমন নিষ্ঠুরতায় আশ্চর্য হয়ে কবি উক্তিটি করেছেন।
৬. গরিব চাষির ঘরের খুঁটি উড়িয়ে নেওয়ায় কবি বাতাসকে কীভাবে কটাক্ষ করেছেন?
উত্তর: গরিব চাষির ঘরের খুঁটি উড়িয়ে নেওয়ায় কবি বাতাসকে মহাপ্রতাপশালী বলে কটাক্ষ করেছেন।
বৈশাখ মাস ঋতুপরিক্রমায় বারবার প্রকৃতিতে ফিরে আসে। প্রকৃতিতে সে তার রুদ্র সংহারক রূপে আবির্ভূত হয়। এর নিষ্ঠুর থাবা থেকে কেউ মুক্তি পায় না। এর মহাপ্রতাপশালী বাতাস গরিব-অসহায় চাষিদের সম্বল, বাসস্থান সব উড়িয়ে নেয়। এই অসহায় মানুষদের ঘরের খুঁটি উড়িয়ে নেয় বলেই কবি বাতাসকে মহাপ্রতাপশালী বলে কটাক্ষ করেছেন।
৭. যারা লোক ঠকিয়ে প্রাসাদ গড়ে তাদের সম্পর্কে কবি কী বলতে
চেয়েছেন?
উত্তর: যারা লোক ঠকিয়ে প্রাসাদ গড়ে তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারায় কবি ঝোড়ো বাতাসকে উপহাস করেছেন।
‘বোশেখ’ কবিতায় কবি বৈশাখী ঝড়কে তিরস্কার করেছেন অসহায়দের উপর নির্দয় হওয়ার জন্য। একইসাথে তিনি পরজীবী ধনিকশ্রেণির ধ্বংস কামনা’ করেছেন প্রচণ্ড ঝড়ের কাছে। লোক ঠকানো এই শ্রেণিটাকে কবি চিহ্নিত করতে চেয়েছেন ‘বিভেদকারী পরগাছা’ হিসেবে।
৮. ‘বোশেখ’ কবিতায় কী প্রসঙ্গে রাজা সোলেমানের কথা বলা
হয়েছে?
উত্তর: ‘বোশেখ’ কবিতায় সুবিচারের প্রসঙ্গে রাজা সোলেমানের কথা বলা হয়েছে।
রাজা সোলেমান ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। তাঁর বাহন ছিল বাতাস। তিনি তাঁর রাজ্যে’ সবসময় সুবিচার করতেন। অত্যাচারীদের শিরশ্ছেদ করতেন, তাদের অহমিকার অট্টালিকা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতেন।। কবি বাতাসের কাছেও রাজা সোলেমানের মতো ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেছেন। বাতাস যেন শুধু অসহায়দের ক্ষতি না করে বরং অত্যাচারী শোষকদের শোষণের সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেয়।
৯. ‘কবিদের এক মহান রাজা রবীন্দ্রনাথ’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘বোশেখ’ কবিতায় কবি আল মাহমুদ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবিদের এক মহান রাজা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অসাধারণ সাহিত্যকর্মের জন্য সারা পৃথিবীতে নন্দিত ও জনপ্রিয়। উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক প্রভৃতি রচনা করলেও কবিতা রচনার জন্য তিনি বিশেষভাবে অমরত্ব লাভ করেছেন। কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ায় তিনি এক্ষেত্রে মহান রাজা বা সম্রাটের আসন গ্রহণ করেছেন। এজন্য ‘বোশেখ’ কবিতায় তাঁকে কবিদের এক মহান রাজা বলা হয়েছে।
১০. রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে ‘বোশেখ’ কবিতায় কী বলা হয়েছে?
উত্তর: ‘বোশেখ’ কবিতায় কালবৈশাখির কাছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিনীত প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে।
‘বোশেখ’ কবিতায় নানা উপায়ে কালবৈশাখির রুদ্র সংহারক রূপ উপস্থাপন করা হয়েছে এবং এর অবসান কামনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতার মাধ্যমে কালবৈশাখির কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করেছেন যেন সে জগতের শুষ্ক মরা, অদরকারি সবকিছু একটি ফুঁয়ের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু কালবৈশাখি যেন দরিদ্র মানুষের দরকারি কোনো কিছুর কোনো ক্ষতি না করে। কবিতাটিতে কালবৈশাখির প্রতি বিশ্বকবির এ প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে।
১১. কবি বিভেদকারী পরগাছাদের ধ্বংস করতে বলেছেন কেন?
উত্তর: বিভেদকারী পরগাছারা শ্রমজীবী মানুষদের শোষণ করে বলে কবি তাদেরকে ধ্বংস করতে বলেছেন।
‘বোশেখ’ কবিতায় কবি বৈষম্য সৃষ্টিকারীদেরকে সমাজের পরগাছা বলে আখ্যায়িত করেছেন। এরা শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ করে বড়ো বড়ো অট্টালিকা গড়ে তোলে কিন্তু শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরিটুকু প্রদান করে না। সমাজের ধনী-গরিবদের মাঝে বৈষম্যের মূল কারণ বিভেদকারী পরগাছাদের শোষণ।
১২. কবি কাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে দিতে বলেছেন এবং কেন বলেছেন?
উত্তর: যারা অন্যের শ্রমে মস্ত দালান গড়েছে, তাদের উপর প্রতিশোধ ‘নেওয়ার জন্য কবি তাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে দিতে বলেছেন।
‘বোশেখ’ কবিতায় কবি বৈশাখের বিধ্বংসী রূপ উপস্থাপনের পাশাপাশি বৈশাখের কাছে সমাজের শোষণকারীদের ধ্বংস কামনা করেছেন। বৈশাখ মাসে ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শুধু গরিব মানুষ। কিন্তু যারা অন্যকে শোষণ করে নিজেরা অট্টালিকা গড়ে তোলে, তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। তাই কবি বৈশাখকে গরিব চাষির ঘরের চালের মতো সমাজের শোষক শ্রেণির বাহাদুরি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে বলেছেন।